হঠাৎ করেই ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে গেলো শফিক। ভ্রমণের নাম শুনেই বরাবরই সে পিছিয়ে এসেছে। কংক্রিটের চার দেয়ালের মাঝে থেকে বাইরের জগত সম্পর্কে তার ধারণা নেহাতি অল্প।

তবে এতদিন সে ঠকে এসেছে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আজকের এই ভ্রমণ। ডিজিটাল বাংলাদেেেশ অজপাড়া গাঁ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হলেও আজ তার মামার বদৌলতে খুব সহজেই তাকে খুঁজে পেল।

শফিকের মামা জনাব দবিরুল হক একজন ভ্রমণ পিপাসু মানুষ। বাংলাদেশের দার্শনিক জায়গার মধ্যে হেন জায়গা নেই যেখানে তার পদচিহ্ন পড়েনি। তিনি ছোটখাটো একটা বেসরকারী অফিসে চাকরি করেন। এখনো বিয়ে করেনি তাই পিছুটান নেই বললেই চলে। মাস শেষে যে বেতন পান তার অর্ধেক ব্যয় করেন ভ্রমণে। এবার গরমের ছুটিতে
বোনের বাড়ি বেড়াতে এসে ভাগ্নের এমন কারাবাস দেখে তিনি বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়েন।

খুব গম্ভির মুখে তিনি বললেন, তুই দেখছি দিনদিন গাছ হয়ে যাচ্ছিস রে শফিক। এভাবে চললে কোন নীড়হারা পাখি গাছ ভেবে তোর মাথায় বাসা বানিয়ে ফেলবে। মামার কথা শুনে শফিক বিকট শব্দ করে হাসলো। তার মামার এমন অদ্ভুত বেপরোয়া জীবন তাকে দারুণ ভাবে আকর্ষণ করে। শফিক মাঝে মাঝে ভাবে তার মামার মতোই সে অকৃতদার থাকবে। সেও বেরিয়ে পড়বে প্রকৃতির টানে নাম না জানা কোন এক অজপাড়া গাঁয়ে।

মামা স্কুল এখন বন্ধ চলো না কোথাও ঘুরে আসি। মাঝে মাঝে খুব একা লাগে তখন মনে হয় যদি পাখি হতে পারতাম তাহলে কিছুদিন ওদের মতন নিশ্চিন্ত মনে স্বাধীনভাবে ঘুরতাম। বাবা-মা আমাকে কোথাও যেতে দিতে চায় না। হাজারো প্রশ্ন সমাধানের পর অনুমতি হয়তো দেয়া হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বয়কট হয়।

এমন হতে থাকলে একদিন দেখবা আমি ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মার মুক্তি দিবো। সেদিন হয়তো আমি স্বাধীনতা পাবো। দবিরুল হক ভাগ্নের দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তার চোখ সজল হয়ে আসছে ধরা গলায় তিনি বললেন ওট ঝটপট গুছিয়ে নে। মা-বাবাকে না জানিয়ে কোথাও যাওয়া কি ঠিক হবে? ছাদ থেকে লাফ দেয়া দেয়া বুঝি ঠিক হবে? না মানে বলে গেলে ঠিক হতো না। এই জন্যই তোর এই অবস্থা। একটা শিক্ষা দেওয়া উচিত আপু আর দুলাভাইকে। তড়াতাড়ি হাত লাগা।

দবিরুল হক ভাগ্নেকে সাথে নিয়ে ছোট্ট একটি ভ্যানে উঠে বসলেন। শোঁ শোঁ শব্দ করে ঘুরতে লাগলো ভ্যানের চাকা। বিস্তীর্ণ মাঠের মাঝ দিয়ে চলে গেছে ছোট্ট একটি রাস্তা। রাস্তার বেহাল অবস্থার সাথে গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থার সাথে বিশেষ সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ঝড়ো বাতাসে সবুজ ধানের শিস ঢেউ খাচ্ছে। দেখে মনে হয় এ যেন এক সবুজ নদী।

যেদিকে চোখ যাই সবুজের মেলা। কচি ধানের মিষ্টি সুবাসে মৌ মৌ করছে রাস্তা। রাস্তার দুধারে বড় বড় কড়াই মেহগনির সারি। কৃষাণ প্রখর রোদে কিছুটা স্বস্থির জন্য গাছের ছায়ায় এসে বসেছে।

মাঠ শেষে জঙ্গলে প্রবেশ করলো রাস্তাটি। জঙ্গলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই বিভূতিভূষণের আরণ্যক উপন্যাসে বর্ণিত লবটুলিয়া বইহার ও আজমাবাদের অরণ্য পর্বতের স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো শফিকের ভাবনায়। বইয়ের পাতায় লেখা প্রতিটা শব্দ তার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে। আম কাঠাল আর বাঁশ ঝাড়ে ছেয়ে আছে রাস্তা। সূর্যের আলো
তেমন ভাবে প্রবেশ করে না এখানে। রাস্তার পাশে নাম না জানা হাজারো গুল্মলতা একসাথে জোড় হয়ে আছে। অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে। দবিরুল হক দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ভিতরে নিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন,

কিরে বেটা কেমন দেখছিস? খুব খুব খুবই সুন্দর। এখন থেকে তোর মনের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে হবে। কি যে বলো মামা! মনের আবার চোখ থাকে নাকি? আর থাকলেই বা তার দৃষ্টিশক্তি আবার কিভাবে বাড়ায়। অবশ্যই থাকে। তোর ক্ষেত্রে সেটা আলাদা। রাতকানা দিনকানা দুটো রোগই হয়েছে তোর। ভিটাসিন-এ এর অভাবে মানষের যেমন দৃষ্টিশক্তির লোপ পায়।

তেমনি সৃষ্টিকর্তার এই বিপুল সৌন্দর্যের উপর বিমুখ হয়ে ঘরে বসে থাকলে অন্তরচক্ষুর ক্ষয় হয়। এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটাই উপায় আমার মতো ভ্রমণ পিপাসু হওয়া। তা না হলে একাকীত্ব দূর করার জন্য ছাদ থেকে লাফ দেয়ার উদ্ভট চিন্তা মাথায় এসে ঘুরপাক খাবে। সারাদিন ভ্রমণের পর পড়ন্ত বিকালের হলুদ আভায় শফিক আপন মনে বলে চললো, অজপাড়া আর ডিজিটাল শব্দের মধ্যে প্রকৃত পার্থক্য কতদূর সেটা খুব কাছ থেকে দেখলাম।

গ্রাম বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যে আজ আমি অভিভূত। এই বাংলাকে নারীর সাথে কেন তুলনা করা হয় গ্রামে না আসলে বোঝা সম্ভব ছিলো না। তপস্বী যেমন তরঙ্গিণীকে দেখে চোখ ফেরাতে পারেনি। অপলক দৃষ্টিতে তার চিরযৌবনা দেহকে খুঁটে খুঁটে দেখেছে। আমিও আজ তাই করলাম। আজ সত্যি আমি এই অপরূপ রূপসি অঙ্গনার প্রেমে পড়েছি।

আধুনিকতার নামে যে ডিজিটাল বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি সে আমাদের দিয়েছে অনেক কিন্তু তার বদৌলতে যা নিয়েছে তার মূল্য নেহাতি অল্প নয়।

শিক্ষার্থী
মো. তুহিন হোসাইন
বিভাগ- বাংলা প্রতিষ্ঠান- ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
স্থায়ী ঠিকানা – হামদহ (শান্তিনগর পাড়া), ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ।